দিনাজপুর জেলার ইতিহাস

admin 10/28/2024 No Comments

দিনাজপুর জেলার ইতিহাস

দিনাজপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

প্রারম্ভিকাঃ

দিনাজপুর জেলা সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ১১২-১২০ ফুট গড় উচ্চতায় অবস্থিত। ভৌগোলিকভাবে এ জেলা ২৫০১৪ এবং ২৫০৩৮ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৮০০৫ ও ৮৫০২৮ ডিগ্রী দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। মোট ১৩ টি উপজেলা নিয়ে গঠিত এই জেলার আয়তন ৩৪৩৭.৯৮ বর্গ কিলোমিটার। ২০২২ সালের জনশুমারী অনুযায়ী এর মোট জনসংখ্যা ৩৩,১৫,২৩৮ জন, যার মধ্যে পুরুষ ১৬,৬০,৯৯৭ জন এবং মহিলা ১৬,৫৩,৩০৫ জন। উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বিভাবে বিস্তৃত এ জেলার উত্তরে ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়, দক্ষিণে গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট, পূর্বে নীলফামারী ও রংপুর জেলা এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য।

 

 লোকশ্রুতি অনুযায়ী জনৈক দিনাজ অথবা দিনারাজ দিনাজপুর রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তার নামানুসারেই রাজবাড়ীতে অবস্থিত মৌজার নাম হয় দিনাজপুর। পরবর্তীতে বৃটিশ শাসনামলে ঘোড়াঘাট সরকার বাতিল করে বৃটিশরা নতুন জেলা গঠন করে এবং রাজার সম্মানে এ জেলার নামকরণ করে দিনাজপুর। কোম্পানী আমলের নথিপত্রে প্রথম দিনাজপুর নামটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। তবে ভৌগলিকভাবে দিনাজপুর মৌজাটি অতি প্রাচীন। দিনাজপুরের ভূতপূর্ব কালেক্টর ও বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ মিঃ ওয়েষ্ট মেকট সর্বপ্রথম দিনাজপুর নাম ও তার উৎস উদঘাটন করেন বলে প্রসিদ্ধি আছে।

দিনাজপুর এর ইতিহাস

ঐতিহাসিক বিবর্তন

দিনাজপুর জেলার বর্তমান আয়তন ৩৪৩৭.৯৮ বর্গ কিলোমিটার। তবে পূর্বে এ জেলা আয়তনে ছিল সুবিশাল। পাল রাজবংশের চরম উন্নতির সময়ে দিনাজপুর সমগ্র রাজশাহী বিভাগ ও ঢাকা জেলার কতকাংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল। জেলারূপে ঘোষিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে এর বিস্তৃতি পূর্বের দিনাজপুর অপেক্ষা অনেক ছোট হয়েছে। ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে ও মুসলিম রাজত্বের পতনের সময়ে বর্তমান মালদহ ও বগুড়া জেলার প্রায় পনের আনা এবং রংপুর রাজশাহী ও পুর্নিয়া জেলার অনেকাংশ দিনাজপুরের অংশ ছিল।ঐতিহাসিক বুকানন এর আয়তন ৫৩৭৪ বর্গমাইল বলে উল্লেখ করেছিলেন।

 

ইংরেজ আমলের মাঝামাঝির দিকে অর্থাৎ ১৭৫৭ হতে ১৮৬১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে পরিচালিত রাজস্ব জরিপে (Revenue Survey) এ সুবিশাল ভূ-ভাগের আয়তন হ্রাস করে ৪,৫৪৩ বর্গমাইলে আনা হয়। ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে তা ৪,১৪২ বর্গমাইলে নেমে আসে এবং ইংরেজ শাসনের শেষ দিকে ৩,৯৪৬ বর্গমাইলে এসে দাঁড়ায়। শাসনকার্য প্রতিষ্ঠা ও সুচারুরূপে তা পরিচালনার জন্য ক্রমাগত আয়তন হ্রাস করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

 

১৮০০ হইতে ১৮০১ খৃষ্টাব্দে দিনাজপুরের বড় বড় এষ্টেট পূর্ণিয়া, রংপুর এবং রাজশাহী জেলার সংগে যুক্ত করা হয়। ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে আর একটি সুবিস্তৃত অংশ বগুড়া ও মালদহ জেলার সাথে যুক্ত করার পূর্ব পর্যন্ত আর কোন রদবদল করা হয়নি।

  

১৮৬৪-১৮৬৫ খৃস্টাব্দে খট্রা নামক একটি সুবিশাল পরগণাকে এ জেলা হতে ছেঁটে বগুড়া জেলার সাথে যুক্ত করা হয়। ১৮৬৮-১৮৭০ সালের দিকে এ জেলার একটি বৃহৎ অংশ বগুড়া ও মালদহ জেলায় যুক্ত হয়। ১৮৯৭-১৯৯৮ খৃষ্টাব্দে এ জেলার দক্ষিণ অংশে অবস্থিত মহাদেবপুর থানা রাজশাহীতে স্থানান্তরিত হয়। পাকিস্তান-পূর্ব আমল পর্যন্ত আর কোন রদবদল হয়নি।

 

১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট রাজ্য ইংরেজ শাসিত ভারতের বুকে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি আলাদা রাষ্ট আত্মপ্রকাশ করে। ঐ সময়ে রাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুসারে এ জেলার দশটি থানা ভারতের পশ্চিম বাংলা প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত হয় এবং পশ্চিম দিনাজপুর জেলা গঠন করে। অপরদিকে পশ্চিম বাংলার জলপাইগুড়ি জেলা হতে তেতুলিয়া, পঞ্চগড়, বোদা, দেবীগঞ্জ ও পাটগ্রাম থানা দিনাজপুরের সাথে যুক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকার শাসনকার্যের সুবিধার্থে পাটগ্রাম থানাটি রংপুরের সাথে এবং দিনাজপুরের দক্ষিণ অংশের ধামইর, পোরশা ও পত্নিতলা থানা তিনটি তৎকালীন রাজশাহীর নওগাঁ মহকুমার সাথে যুক্ত করে। সর্বশেষ ১৯৮৪ সালে দিনাজপুরের দুটি মহকুমা ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় আলাদা জেলার মর্যাদা লাভ করে।

দিনাজপুর ইতিহাস

দিনাজপুর শহরের গোড়াপত্তনঃ

বাংলাদেশে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের সূচনায় সৃষ্ট জেলা শহরগুলির অন্যতম ছিল দিনাজপুর। পলাশী যুদ্ধের আট বছর পর ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে ইংরেজ সেনাবাহিনী অত্র এলাকা জয় করে। ফলে নবাবী শাসনের অবসান হয়, পতন হয় সাবেক রাজধানী ঘোড়াঘাট নগরের। এরপর গড়ে উঠতে শুরু করে দিনাজপুর শহর।

 

ইংরেজ-পূর্ব যুগে প্রায় সমগ্র উত্তরবঙ্গ এলাকা নিয়ে নবাব শাসিত ঘোড়াঘাট সরকারের (জেলা) ব্যাপ্তি ছিল এবং সরকারের শাসনাধিকরণ ছিল ঘোড়াঘাট নগর। এই সরকারের সর্বশেষ মুসলিম ফৌজদার মীর করম আলী ইংরেজ সেনাপতি মিঃ কোর্ট্রিল এর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হন। ফলে ঘোড়াঘাট নগরসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চল ইংরেজদের পদানত হয়। বিজয়ী কোম্পানী সরকার কর্তৃক উত্তর বঙ্গ শাসনের জন্য যে বৃহৎ জেলাটি গঠিত হয়(১৭৮৬), তার শাসনাধিকরণ বা জেলা শহর স্থাপিত হয় দিনাজপুর নামক মৌজায়। এই মৌজায় দিনাজপুর রাজবংশের রাজধানী ছিল প্রথমাবধি। সেই সূত্রে একই মোজায় ইংরেজ আমলের জেলা শহরটিরও সুত্রপাত ঘটে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।

 

দিনাজপুর গেজেটিয়ারের মতে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জেলা শাসনের জন্য দিনাজপুরে স্বতন্ত্র স্থায়ী কালেক্টরেট স্থাপিত হয়। মিঃ গেস্নজিয়ারের মতে তার পূর্ব পর্যন্ত দিনাজপুর-রংপুর যুক্ত কালেক্টরেট ছিল। রাজসেরেস্তা থেকে নথিপত্র প্রত্যাহার করে জিলা স্কুলের পুরাতন ভবনটিতে (সম্প্রতি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে) আদি কালেক্টর অফিস স্থাপিত হয়। জেলা স্কুল হওয়ার পূর্বে ভবনটি রাজকাচারী ছিল। তখন কালেক্টর ছিলেন মি. ম্যারিওয়েট। রাজা ছিলেন রাজবংশের নাবলক উত্তরাধিকারী রাজা রাধানাথ। তবে কম্পানির চক্রান্তে নাবালক রাজার রাজজমিদারীর ছিল চরম ছিন্নভিন্ন অবস্থা।

 

১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে বিভাগ ও উপবিভাগ গঠিত হওয়ায় দিনাজপুর জেলায় প্রথম নিয়মিত শাসননীতি প্রবর্তন করেন কালেক্টর মিঃ এইচ জে হ্যাচ। তজ্জন্য গোলকুঠির চত্বরে স্থায়ী কালেক্টরেট ভবন নির্মিত হয় এবং নিয়মিত নথিপত্র প্রবর্তন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাও চালু হয়। গেজেটিয়ারের মতে মিঃ হ্যাচ কঠোর সাম্রাজ্যবাদী, প্রভুত্ববাদী তথা ঝানু কূটবুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। তারই ব্যবস্থাপনায় জেলায় প্রথম বৃটিশ ধারায় শাসন কাঠামো প্রচলিত হয়, যা আজ পর্যন্ত কালেক্টরেট-কেন্দ্রিক শাসনের গতিধারায় প্রবহমান।

 

গেজেটিয়ারে প্রাপ্ত তথ্য মতে মিঃ হ্যাচের আমলে দিনাজপুরে প্রথম নিজস্ব কালেক্টর ভবন নির্মিত হয় (১৭৮৬)। বাহাদুর বাজার মহল্লায় অবস্থিত উক্ত ভবনের নাম ছিল ‘গোলকুঠি প্রাসাদ’। মধ্যযুগের ইউরোগীয় স্থাপত্য ঢঙে নির্মিত এই প্রাসাদ দিনাজপুরের এক বিশিষ্ট নিদর্শন। মি. হ্যাচ ১৭৮৬-১৭৯৩ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত দিনাজপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। বিপত্নীক মি. হ্যাচ কেশরী বিবি নামক এক দেশীয় মেয়েকে বিয়ে করেন। প্রাসাদ চত্বরের চারিদিকে নির্মিত হয় দিনাজপুরের প্রথম কালেক্টরেটের দাপ্তরিক ভবন।

 

দিনাজপুরে ইংরেজ শাসনের প্রবর্তন ও জেলা কালেক্টরেট নির্মিত হওয়ায় এবং সেই সঙ্গে সুবিন্যস্ত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় আধুনিক জেলা শহরটির গড়ন শুরু হয় রাজাদের দেয়া ক’টি মৌজার ওপর। রাজবাড়ী থেকে সমস্ত ইংরেজ নথিপত্র প্রত্যাহার করে গোলকুঠি ভবনে স্থাপন করা হয়। মুগল আমলের ঘোড়াঘাট নগর তখন সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত।

  

দিনাজপুর শহর পৌরাণিক নদী পুনর্ভবার তীরে অবস্থিত। অবশ্য ভূ-তাত্ত্বিকভাবে শহরটি গড়ে উঠেছে ঘাঘরা নামক একটি মৃত নদীর গর্ভভূমির উপর। মৃত ঘাঘরা-গাবুরা-কাচাই প্রভৃতি নদী এক সময় পুনর্ভবারই উপনদী ছিল। শহরটির সূচনা যুগে সে সব নদীর প্রবল স্রোতধারা বহমান ছিল। দিনাজপুর গেজেটিয়ারের মতে ঘাঘরা-কাচাই (কাঁচমতি)-গাবুরা-গর্ভেশ্বরী নদী অভিন্ন সম্পর্কে জড়িত এবং প্রায় একই উৎস থেকে উৎপন্ন। শহরের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত আগত এবং রাজবাড়ীর পূর্ব দিক হয়ে দক্ষিণ দিকে ধাবমান মৃতপ্রায় নদীটির নাম গাবুরা বা গর্ভেশ্বরী এবং শহরের বুক চিরে অধুনা যে ক্ষীণকায় আধমরা ধারাটি পুনর্ভবায় মিলিত হয়েছে তা ঘাঘরা নামে পরিচিতি।

 

মুগল আমলের ঘোড়াঘাটকে বলা হতো ৫২ পট্টি ও ৫৩ গলির শহর, তেমনি বৃটিশ আমলের দিনাজপুর ছিল ৭ তলা ও ৮ পট্টির শহর। তলা অন্ত্যনামীয় মৌজাগুলি নিমতলা, গনেশতলা, কালিতলা, ষষ্ঠীতলা, ফুলতলা, বকুলতলা, লক্ষীতলা এবং পট্টি অন্ত্যনামীয় মৌজাগুলি হল মালদহপট্টি, ঢাকালপট্টি, চুড়িপট্টি, শাখারীপট্টি, কাঁয়াপট্টি, বাসুনিয়াপট্টি, চাউলিয়াপট্টি এবং ঠোঙ্গাপট্টি ইত্যাদি।বর্তমানে শহরটির মোট মহল্লার সংখ্যা ২৬টি। পূর্বের তুলনায় মৌজা সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও তলা বা পট্টি অন্ত্যনামীয় কোন নতুন মৌজা অন্তর্ভূক্ত হয়নি।

 

দিনাজপুর গেজেটিয়ারে দেয়া বিবরণ মতে পুরাতন আমলের দিনাজপুর শহরটির সাধারণ পরিচয় ছিল নিম্নরূপঃ

 ইতিহাস দিনাজপুর

রায়গঞ্জ: শহরটির মূল এলাকা। এটা ছিল প্রধানতঃ বাজার, বিপণী এবং ব্যবসায়ীদের লগ্নী ব্যবসা ও বান্ধাই মজুদ ব্যবসার কেন্দ্রীভূত স্থান।

 

কাঞ্চনঘাট: নদীর নিকটবর্তী শহরের পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকা। স্থানটির বৈশিষ্ট্য দেখে মনে হয় পূর্বে এটা বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে(ষ্ট্রং সাহেবের সময়, ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ) স্থানটিতে অবস্থাশালী উচ্চ শ্রেণীর লোকদের বাড়ীঘর ও বাগান গড়ে ওঠে।

 

পাহাড়পুর: শহরের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকা। এখানে বর্তমানে জেলখানা, হাসপাতাল, রেল ষ্টেশন, অফিস-আদালত এবং সরকারী কর্মচারীদের বাসস্থান গড়ে উঠেছে।

 

পুলহাট:শহরের দক্ষিণে অবস্থিত। এখানে রয়েছে অনেক ধানকল এবং ধান-চালের বড় বড় আড়ত বা গোলাঘর। ধানকল ও গোলা-গুদামেরআধিক্য থেকে মনে হয় প্রথম থেকেই এটি একটি শিল্প এলাকারূপে গড়ে উঠতে শুরুকরেছিল। এখানে একটি দ্বিসাপ্তাহিক বাজারও বসে।

 

শহরের অন্তর্ভূক্ত এসব বিশিষ্ট এলাকা পরবর্তীতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহল্লায় ভাগ হয়েছে। যেমন রাজগঞ্জ এলাকার মধ্যে মুন্সীপাড়া, নিমতলা, গনেশতলা, ক্ষেত্রীপাড়া, কাঁয়াপট্টি, বাসুনিয়াপট্টি প্রভৃতি নতুন মহল্লা সৃষ্টি হয়। পশ্চিম দিকে নদীর তীরভুমি পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাটি ষষ্ঠীতলা, বালুয়াডাঙ্গা, ঘাসিপাড়া, চাউলিয়াপট্টি প্রভৃতি নামে অভিহিত হয় এবং শহরের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় গড়ে ওঠে বালুবাড়ী মহল্লা। ষষ্ঠীতলা, ঘাসিপাড়া, কালীতলা, বড়বন্দর, বালুবাড়ীএবং কিছু শহরতলী এলাকায় স্থানীয় ভদ্র পরিবারগুলির বাড়ীঘর ঐ সময় থেকেই গড়েউঠে। বড় মাঠের পশ্চিমে বর্তমান মিশন রোড মহল্লা প্রথম থেকেই সাহেববাড়ীমহল্লা নামে পরিচিত ছিল।

 

বর্তমানে দিনাজপুর একটি বর্ধিষ্ণু শহর। এখানে রয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, একটি মেডিক্যাল কলেজসহ আধুনিক স্বাস্থ্য পরিসেবার সকল সুযোগ-সুবিধা।

 

প্রাগ-ঐতিহাসিক দিনাজপুরঃ

 

সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্যমন্ডিত দিনাজপুরের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের ছোট নাগপুর, বিন্ধ্যাপর্বত প্রভৃতি লক্ষ লক্ষ বছরের প্রাচীন স্থানগুলির মাটির সমগোত্রীয়দিনাজপুরের মাটি। বহুকাল পূর্বে হিমালয় পর্বতের ভগ্নীরূপে জন্ম নেয়াবরেন্দ্র ভূমির হৃদয়-স্থানীয় স্থান দিনাজপুর।

 

 চৈনিকও ইউরোপীয় ভ্রমণকারীদের বিবরণীতে বৃহৎ ও সুনাব্য নদীরূপে বর্ণিত করতোয়ানদীর তীরে কোন এক অজ্ঞাত সময় থেকে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। করতোয়ারতীরে গড়ে উঠে বলে একে করতোয়া সভ্যতা হিসেবে অভিহিত করা যায়। অনুমিত হয়, মধ্যযুগে মহাস্থান, বানগড় এবং মোগল যুগে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটই ছিল এই সভ্যতার প্রধান নাগরিক কেন্দ্র। ইতিহাস খ্যাত পঞ্চনগরী দিনাজপুরেই অবস্থিত ছিল।

  

পাল ও সেন আমলে দিনাজপুরঃ

যমুনা-করতোয়ার অববাহিকায় অবস্থিত এ নগরীর বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষগুলি চরকাই, বিরামপুর, চন্ডীপুর, গড়সিংলাই, দামোদরপুরইত্যাদির ধ্বংসাবশেষ নামে পরিচিত। মৎস্যন্যায় যুগে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় করতোয়া নদীর পাড়ে এক উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ বিহার নির্মিত হয়।স্থাপত্য শৈলীর বিবেচনায় এটি বাংলাদেশে আবিষ্কৃত বৌদ্ধ বিহারের মধ্যেতৃতীয় স্থানীয়। ১৯৬৮ সালে প্রথম বার এবং ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয় বার খননের পর৪১টি প্রকোষ্ঠসহ বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। এখানের অনেক প্রত্নদ্রব্য দিনাজপুর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। ৮ম শতকে গোড়াপত্তন হওয়াপাল বংশের ভ্রাম্যমাণ রাজধানীর বহু ধ্বংসাবশেষ দিনাজপুরের মাটিতে মিশে আছে। পাল রাজত্ব কালে পার্বত্য কম্পোজ জাতির আক্রমণ এবং কৈবর্ত বিদ্রোহের ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে দিনাজপুর। সেন রাজত্বকালে নির্মিত অসংখ্য দেব-দেবীর প্রস্তরমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে দিনাজপুরসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায়।

 

আফগান ও মুঘল আমলে দিনাজপুরঃ

লক্ষ্মণ সেনকে বিতাড়িত করে বিজেতা বখতিয়ার খিলজী ১২০৪ সালে বরেন্দ্র ভূমি বিজয় করেদিনাজপুরের দেবকোটে মুসলিম রাজধানী স্থাপন করেন। ১২২০ সালে গৌঁড়ে স্থানান্তরিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দেবকোর্টই ছিল বাংলার রাজধানী।

  

চেহেলগাজীগণ দিনাজপুরের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণঅংশ। রাজা গোপালের সময় ইসলামের বার্তা নিয়ে চেহেলগাজীদের আবির্ভাব হয়।ন্যায়ের স্বার্থে রাজা গোপালের সেনাদলের সাথে ভয়ানক যুদ্ধে মুজাহিদগণ শহীদহয়েও ভক্তদের মনে মহান গাজীত্বের সম্মান লাভ করেন। গাজীগণ সংখ্যায় ৪০ জনহওয়ায় তাঁদের ৫৪ ফুট দীর্ঘ সমাধিস্থলটি চেহেলগাজীর মাজার নামে পরিচিত যাদিনাজপুর শহরের উত্তর উপকন্ঠে অবস্থিত। এছাড়া দিনাজপুরের গড়মল্লিকপুর এবং খানসামার দুহসুহ গ্রামে যথাক্রমে ৮৪ ফুট এবং ৪৮ ফুট দীর্ঘ দুটি মাজার আছেযা যথাক্রমে গঞ্জে শহীদ এবং চেহেলগাজী নামে পরিচিত।

  

দিল্লীশাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সুরক্ষায় ইলিয়াস শাহ্ কর্তৃক নির্মিত ঐতিহাসিকএকডালা দুর্গের অবস্থানও ছিলো দিনাজপুরের মধ্যেই। হত্যার রাজনীতির মাধ্যমেগৌড়ীয় সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহকে অপসারণ করে গৌড়ের মসনদে আরোহণ কারীরাজা গণেশ দিনাজপুরের অধিবাসী ছিলেন। পরবর্তীতে গণেশ পুত্র যদু ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে জালালুদ্দীন নাম ধারণকরে গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

  

গৌড়ীয়সুলতান বরবক শাহের সেনাপতি ইসমাইল গাজীর নেতৃত্বে আত্রাই নদীর তীরবর্তীমাহিসন্তোষ নামক স্থানে কামতারাজের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং পরে কামতাপুরদুর্গ (দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে) বিজীত হয়। ঘোড়াঘাটে করতোয়া নদীর পশ্চিমতীরে ইসমাইল গাজী এক মুসলিম নগরীরগোড়াপত্তন করেন। পরবর্তী কালে ইহা বিখ্যাত ঘোড়াঘাট সরকার নামে পরিচিত হয়।জিন্দাপীর নামে অভিহিত ইসমাইল গাজী ও বহু আউলিয়ার মাজার ঘোড়াঘাটে বিদ্যমান।

  

১৪৬০খ্রিস্টাব্দেসুলতান বরবক শাহ সম্পাদিত এবং চেহেলগাজীর মাজারে প্রাপ্ত একটি ফার্সীশিলালিপি থেকে জানা যায় দিনাজপুর শহরসহ উত্তরাংশের শাসনতান্ত্রিক এলাকারশাসনকর্তা নসরত উলুখ নসরত খাঁন চেহেলগাজী মাজারের পাশে একটি মসজিদ নির্মাণকরেন, যা বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন মসজিদ বলে চিহ্নিত। হোসেন শাহী আমলের বিভিন্ন মসজিদ ও ইসলাম প্রচারকের মাজার দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট, দেবকোটসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে। এছাড়া দিনাজপুরের বুকে শেরশাহী আমলের মসজিদ, সড়ক ও সেতু শূরবংশীয় অধিকারের প্রমাণ বহন করে।

  

মোগল আমলে বাংলা বিজয়ের পর সমগ্র বাংলাদেশকে ২৪টি সরকারে ভাগ করা হয়। এতে দিনাজপুরে ঘোড়াঘাট, বরকাবাদ, তাজপুর এবং পিঞ্জরা নামের ৪টি সরকারঅন্তর্ভুক্তহয়। সবদিক বিবেচনায় বাংলার ঘোড়াঘাট শ্রেষ্ঠ সরকার ছিল। ঘোড়াঘাটের শেষ ফৌজদার ছিলেন ঐতিহাসিক গ্রন্থ ’মোজাফফরনামা’রচয়িতা করম আলী খান। সেসময় মসজিদ ও মুসলিম নগরীতে পরিণত হয় মোগল আমলের ঘোড়াঘাট। বিখ্যাত সূরা মসজিদ ও আউলিয়াদের মাজারে ধন্য হয় ঘোড়াঘাট।

  

দিনাজপুর রাজ পরিবারঃ

লোকশ্রুতি অনুযায়ী জনৈক দিনাজ অথবা দিনারাজ দিনাজপুর রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নামানুসারেই দিনাজপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে। মুগল সম্রাট আকবরেরশাসনামলে ব্রহ্মচারী ও মোহন্ত হিসেবে পরিচিত কাশী ঠাকুর নামক একজনসন্ন্যাসী দিনাজপুর ও মালদা জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকারী হন। তিনিনিজেকে রাজা গণেশের বংশধর বলে দাবি করতেন। জানা যায় তিনি তাঁর সমস্তসম্পত্তি তাঁর প্রিয়ভাজন কায়স্তশিষ্য শ্রীমন্ত দত্ত চৌধুরীকে উইল করে দিয়ে যান। পরবর্তীকালে এ সম্পত্তি শ্রীমন্তের দৌহিত্র সুখদেব উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। সুখদের রংপুর, বগুড়া ও মালদার অংশবিশেষে প্রতিষ্ঠিত জমিদারি পেয়েছিলেন। তিনি এ জমিদারি দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও এর অন্তর্ভূক্ত নবাবপুর, ক্ষেতলাল, শিবগঞ্জ, পাঁচবিবি, বদলগাছি ও আদমদিঘি অঞ্চলে সম্প্রসারণ করেন।

  

তাঁর বিশাল জমিদারি বিবেচনা করে সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৭৭ খিষ্টাব্দে তাঁকে ’রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৬৮২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র প্রাণনাথ তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনিই ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি। প্রাণনাথই ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে পোড়ামাটির অলংকরণসমৃদ্ধ অসাধারণ কান্তনগর মন্দিরটির (নবরত্ন মন্দির) নির্মাণশুরু করেন। তবে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় এ মন্দিরের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেযেতে পারেননি। মন্দিরটি নির্মাণে প্রায় ত্রিশ বছর সময় লাগে এবং ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি (পালক পুত্র) রামনাথ এটি সম্পন্ন করেন। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ভয়াবহ ভূমিকম্পে কান্তজী নবরত্নমন্দির ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয় এবং পরবর্তীকালে মহারাজা গিরিজানাথ রায়বাহাদুর মন্দিরটির সংস্কার করেন। তাঁর পালক পুত্র জগদীশনাথের আমলে ইস্ট বেঙ্গল এস্টেট অ্যাকুইজিশন এ্যাক্ট, ১৯৫০ অনুসারে এই জমিদারি বিলুপ্ত হয়। ১৯৬২ সালে কলকাতায় জগদীশনাথ মৃত্যুবরণ করেন।

 

বিরামপুর রখুনি কান্ত জমিদার বাড়ি

দিনাজপুরে ব্রিটিশ শাসনের সূচনাঃ

১৭৬৫খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সেনাপতি মিঃ কোট্রিল ঘোড়াঘাটের শেষ মুসলিম ফৌজদার করমআলী খানকে পরাজিত করে এই অঞ্চলে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এ অঞ্চলেপ্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ইংরেজরা ১৭৮৬ সালে নতুন জেলা গঠন করে এবং ১৭৯৩সালে দিনাজপুরে এই জেলার দপ্তর স্থাপন করা হয়। ১৮৩৩ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্তদিনাজপুরের বিভিন্ন অংশ পূর্ণিয়া, রংপুর ও রাজশাহীর মধ্যে অন্তর্ভুক্তি ও বিচ্যুতি ঘটে। দিনাজপুরের কালেক্টর মিঃ এইচ, জে হ্যাচের(১৭৮৬-১৭৯৩ পর্যন্ত কালেক্টর ছিলেন) আমলে দিনাজপুরে প্রথম নিজস্ব কালেক্টরেট ভবন নির্মিত হয় বর্তমান বাহাদুর বাজারস্থ গোলকুঠি বাড়ীতে।

 

জেলার প্রশাসনিক বিন্যাসঃ

বর্তমানে ১৩ টি উপজেলার সমন্বয়ে দিনাজপুর জেলা গঠিত। এ জেলার মোট ইউনিয়নের সংখ্যা ১০১, পৌরসভা ০৮টি এবং মৌজা ২,০২০টি।

  

সংক্ষিপ্ত উপজেলা পরিচিতিঃ

ক্র.নং নাম আয়তন(বর্গকিমি) জনসংখ্যা জেলাশহরের যেদিকে জেলাশহর থেকে দূরত্ব
০১ বিরল ৩৫২.১৫ ২৩১৪৭৬ পশ্চিম ১২কিমি
০২ বোচাগঞ্জ ২২৪.৮১ ১৩৫৩৭৬ পশ্চিম ২৫কিমি
০৩ কাহারোল ২০৫.৫৪ ১১৮৩৭৯ উত্তর-পশ্চিম ২৫কিমি
০৪ বীরগঞ্জ ৪১৩.০০ ২৬৯৮৯৩ উত্তর-পশ্চিম ৩০কিমি
০৫ খানসামা ১৭৯.৭২ ১২৩৭৮২ উত্তর ৩৫কিমি
০৬ দিনাজপুরসদর ৩৫৪.৩৪ ৩৫৭৮৮৮ উত্তর ০৬কিমি
০৭ চিরিরবন্দর ৩০৮.৬৮ ২৩২৪০৯ উত্তর-পূর্ব ১৫কিমি
০৮ পার্বতীপুর ৩৯৫.১০ ২৭০৯০৪ উত্তর-পূর্ব ২৫কিমি
০৯ ফুলবাড়ি ২২৯.৫৫ ১২৯৪৩৫ পূর্ব ৪০কিমি
১০ বিরামপুর ২১১.৮১ ১৩৪৭৭৮ পূর্ব ৬০কিমি
১১ নবাবগঞ্জ ৩১৪.৬৮ ১৭০৩০১ পূর্ব ৭০কিমি
১২ হাকিমপুর ৯৯.৯২ ৬৬৮৭৬ দক্ষিণ-পূর্ব ৭৫কিমি
১৩ ঘোড়াঘাট ১৪৮.৬৭ ৮৪২৭৯ পূর্ব ১০০কিমি

 

 বিরলঃ

বিরল উপজেলার মোট আয়তন ৩৫২.১৫ বর্গ কিমি। উত্তরে বোচাগঞ্জ ও কাহারোল উপজেলা, দক্ষিণে দিনাজপুর সদর উপজেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, পূর্বে দিনাজপুর সদর উপজেলা ও পুনর্ভবা নদী, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ(ভারত) ও বোচাগঞ্জ উপজেলা। প্রধান নদী: পুনর্ভবা ও টাংগন। কড়াই ও নল বিল উল্লেখযোগ্য। বিরল থানা সৃষ্টি ১৯১৫ সালে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৪ সালে। ইউনিয়ন ১০, মৌজা ২৪১, গ্রাম ২৩৫।বিরল উপজেলার মোটজনসংখ্যা২৩১৪৭৬; পুরুষ ৫১.৫৫%, মহিলা ৪৮.৪৫%। মুসলমান ৭২.২৩%, হিন্দু ২৬.০৪%, বৌদ্ধ ০.৪৮%, খ্রিষ্টান ০.০২%, অন্যান্য ১.২৩%।

 

বিরল উপজেলারবগুলাখাড়িনামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকসেনাদের এক যুদ্ধে অনেক পাকসেনা নিহতহয় এবং অন্যান্যরা ঐ স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়পাকিস্তানী সৈন্যদের চলাচল বিঘ্নিত করার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা কাঞ্চননদীর উপরের ব্রীজটি ধ্বংস করে।

 

 বোচাগঞ্জঃ

বোচাগঞ্জ উপজেলার মোট আয়তন ২২৪.৮১ বর্গ কিমি। উত্তরে বীরগঞ্জএবং পীরগঞ্জ(রংপুর) উপজেলা, দক্ষিণে বিরল উপজেলা ও ভারতের পশ্চিবঙ্গ, পূর্বে বীরগঞ্জ, কাহারোল এবং বিরল উপজেলা, পশ্চিমে পীরগঞ্জ(রংপুর) উপজেলা। প্রধান নদী: টাংগন। বোচাগঞ্জ থানা সৃষ্টি ১৯১৫ সালেএবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৪ সালে। পৌরসভা ১(সেতাবগঞ্জ), ইউনিয়ন ৬, মৌজা ১৪৪, গ্রাম ১৪৬।বোচাগঞ্জ উপজেলার মোট জনসংখ্যা ১৩৫৩৭৬; পুরুষ ৫১.৭৭%, মহিলা ৪৮.২৩%। মুসলমান ৬০.২৪%, হিন্দু ৩৭.৭৫%, খ্রিষ্টান ০.৪৯%, অন্যান্য ১.৫২%।

 

১৯৭১ সালেমুক্তিযুদ্ধের সময় এ উপজেলার মেহেরপুর হাটে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদেরযুদ্ধ হয়। এ সময় পাকবাহিনী পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রাম ভস্মীভূত করে।

 

 কাহারোলঃ

কাহারোল উপজেলার মোট আয়তন ২০৫.৫৪ বর্গ কিমি। উত্তরে বীরগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণে দিনাজপুর সদর ও বিরল উপজেলা, পূর্বে খানসামা ও দিনাজপুর সদর উপেজলা, পশ্চিমে বোচাগঞ্জ উপজেলা। প্রধান নদী: পুনর্ভবা, আত্রাইএবং ঢেপা। কঞ্চন ও হাঁস বিল উল্লেখযোগ্য। ১৯০৪ সালে কাহারোল থানা সৃষ্টিএবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৪ সালে। ইউনিয়ন ৬, মৌজা ১৫৩, গ্রাম ১৫২।কাহারোল উপজেলার মোট জনসংখা ১১৮৩৭৯; পুরুষ ৫১.৭৭%, মহিলা ৪৮.২৩%। মুসলমান ৫২.৯৩%, হিন্দু ৪৪.৯০%, খ্রিষ্টান ০.৬২% এবং অন্যান্য ১.৫৫%।

 

১৯৭১ সালে মদনপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়, এতে কিছু পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। আব্দুল আওয়াল নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে নহত হন।

 

 বীরগঞ্জঃ

বীরগঞ্জ উপজেলার মোট আয়তন ৪১৩ বর্গ কিমি। উত্তরে ঠাকুরগাঁও সদর ও দেবীগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণে কাহারোল উপজেলা, পূর্বে আত্রাই নদী ও খানসামা উপজেলা, পশ্চিমে বোচাগঞ্জ, পীরগঞ্জ(রংপুর) ও ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা। প্রধান নদী: আত্রাই, পুনর্ভবা। প্রধান বিল: পাইসা, লাল এবং চন্দ্রগোভার। থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৩ সালে। ইউনিয়ন ১১, মৌজা ১৮৭ এবং গ্রাম ১৮৬।বীরগঞ্জ উপজেলার মোট জনসংখ্যা ২৬৯৮৯৩; পুরুষ ৫১.২৩%, মহিলা ৪৮.৭৭%। মুসলমান ৬৯.২০%, হিন্দু ২৮.৩৮%, বৌদ্ধ ১.১২%, খ্রিষ্টান ০.০৪%, অন্যান্য ১.২৬%।

 

বীরগঞ্জ উপজেলা তেভাগা আন্দোলন এবং সাঁওতাল বিদ্রোহের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। এখানকার জনগন মুক্তিযুদ্ধসহ অনেক ঐতিহাসিক আন্দোলনে সক্রিয় ভৃমিকা পালনকরেছে।

 

 খানসামাঃ

খানসামা উপজেলার আয়তন ১৭৯.৭২ বর্গ কিমি। উত্তরে দেবীগঞ্জ ও নীলফামারী সদর উপজেলা, দক্ষিণে চিরিরবন্দর ও দিনাজপুর সদর উপজেলা, পূর্বে নীলফামারী সদর উপজেলা, পশ্চিমে কাহারোল ও বীরগঞ্জ উপজেলা। প্রধান নদী: আত্রাই ও আপার করতোয়া। খানসামা থানা সৃষ্টি ১৮৯১ সালে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৩ সালে। ইউনিয়ন ৬, মৌজা ৫৭, গ্রাম ৫৭। জনসংখ্যা১২৩৭৮২; পুরুষ ৫১.৭৭%, মহিলা ৪৮.২৩%। মুসলমান ৬৯.৯১%, হিন্দু ২৯.৭৫% এবং অন্যান্য ০.৩৪%।

 স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সুবেদার মজিদের নেতৃত্বে আত্রাই নদীর তীরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকসেনাদের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে সুবেদার মজিদ শহীদ হন।

 

 দিনাজপুর সদরঃ

দিনাজপুর সদর উপজেলার মোট আয়তন ৩৫৪.৩৪ বর্গ কিমি। উত্তরে কাহারোল এবং খানসামা উপজেলা, দক্ষিণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, পূর্বে চিরিরবন্দর উপজেলা, পশ্চিমে বিরল উপজেলা। প্রধান নদী: পুনর্ভবা ও আত্রাই। দিনাজপুর সদর থানা সৃষ্টি ১৮৯৯ সালে এবং থানাকে উপজেলা করা হয় ১৯৮৩ সালে। ইউনিয়ন ১৪, মৌজা ২৯১, গ্রাম ২০৫।দিনাজপুর সদর উপজেলার মোট জনসংখ্যা৩৫৭৮৮৮; পুরুষ ৫১.৭৭%, মহিলা ৪৮.২৩%। মুসলমান ৮১.৬২%, হিন্দু ১৬.২৮%, খ্রিষ্টান ০.৭১% এবং অন্যান্য ১.৩৯%।

 

মহান মুক্তিযুদ্ধে ২৭ মার্চ, ১৯৭১ তারিখ দিনাজপুর কুঠিবাড়ির পতন হয় এবং দিনাজপুর শহর ১৪ এপ্রিল, ১৯৭১ পর্যন্ত মুক্তাঞ্চল হিসাবে টিকে থাকে। ২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে বড়মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

দিনাজপুর জেলা বিখ্যাত কেন?

 

চিরিরবন্দরঃ

চিরিরবন্দর উপজেলার মোট আয়তন ৩০৮.৬৮ বর্গ কিমি। উত্তরে খানসামা উপজেলা, দক্ষিণে ফুলবাড়ী উপজেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, পূর্বে পার্বতীপুর উপজেলা, পশ্চিমে দিনাজপুর সদর উপজেলা। প্রধান নদী: ছোট যমুনা ও আত্রাই। চিরিরবন্দর থানা সৃষ্টি ১৯১৪ সালে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৪ সালে। ইউনিয়ন ১২, মৌজা ১৪৫, গ্রাম ১৪১।চিরিরবন্দর উপজেলার মোট জনসংখ্যা২৩২৪০৯; পুরুষ ৫১.৭৭%, মহিলা ৪৮.২৩%। মুসলমান ৭৫.১৮%, হিন্দু ২৩.৭৭%, খ্রিষ্টান ০.২৪%, অন্যান্য ০.৮১%।

 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দশ মাইল নামক স্থানে পাকসেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদেরমধ্যে এক সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধা মাহাতাব বেগ শহীদ হন। পাকসেনারা তার মস্তকছিন্ন করে নিয়ে যায়।

 

 পার্বতীপুরঃ

পার্বতীপুর উপজেলার মোট আয়তন ৩৯৫.১০ বর্গ কিমি। উত্তরে সৈয়দপুর উপজেলা, দক্ষিণে ফুলবাড়ী উপজেলা, পূর্বে বদরগঞ্জ উপজেলা, পশ্চিমে চিরিরবন্দর উপজেলা। নদী ৬ টি; চিরনল, খরখড়ি, ছোট যমুনা উল্লেখযোগ্য। থানা সৃষ্টি ১৮০০ সালে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৩ সালে। ইউনিয়ন ১৩, মৌজা ১৯৪, গ্রাম ২৩০।পার্বতীপুর উপজেলার মোট জনসংখ্যা ২৭০৯০৪; পুরুষ ৫১.৪৬%, মহিলা ৪৮.৫৪%। মুসলমান ৮৪.৪৯%, হিন্দু ১৩.৮৬%, খ্রিষ্টান ০.৪১, অন্যান্য ১.২৪%। এই উপজেলায় ৩০৫টি সাঁওতাল পরিবার রয়েছে।

 

১৯৪৭সালে দেশ বিভাগের সময় ভারত থেকে অনেক অবাঙালি মুসলমান পার্বতীপুরে এসে বসতি গড়ে তোলে। পাকিস্তান আমলে এই জনগোষ্ঠী আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়। মুক্তিযুদ্ধেরসময় এখানকার উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী পাকসেনাদের সাথে মিলিত হয়ে প্রচুর বাঙালি হত্যা করে।

 

 ফুলবাড়ীঃ

ফুলবাড়ী উপজেলার মোট আয়তন ২২৯.৫৫ বর্গ কিমি। উত্তরে পার্বতীপুর ও চিরিরবন্দর উপজেলা, দক্ষিণে বিরামপুর উপজেলা, পূর্বে নবাবগঞ্জ উপজেলা (দিনাজপুর) ও বিরামপুর উপজেলা, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। উল্লেখযোগ্য নদী: ছোট যমুনা। ফুলবাড়ী থানা সৃষ্টি ১৮৫৭ সালে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৪ সালে। ইউনিয়ন ১০, মৌজা ১৭০, গ্রাম ১৫০। ফুলবাড়ি উপজেলার মোট জনসংখ্যা ১২৯৪৩৫; পুরুষ ৫১.৭৭%, মহিলা ৪৮.২৩%। মুসলমান ৮১.৫৪%, হিন্দু ১৪.৭৫%, খ্রিষ্টান ০.৬০%, অন্যান্য ৩.১১%।

 

 বিরামপুরঃ

বিরামপুর উপজেলার মোট আয়তন ২১১.৮১ বর্গ কিমি। উত্তরে ফুলবাড়ী ও নবাবগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণে হাকিমপুর উপজেলা ও পশ্চিমবঙ্গ(ভারত), পূর্বে নবাবগঞ্জ ও হাকিমপুর উপজেলা, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ(ভারত) ও ফুলবাড়ী উপজেলা। প্রধান নদী: যমুনা। প্রধান বিল: অশোলার। বিরামপুর থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৩ সালে। ইউনিয়ন ৭, মৌজা ১৭১, গ্রাম ১৮৯।বিরামপুর উপজেলার মোট জনসংখ্যা১৩৪৭৭৮; পুরুষ ৫১.৬০%, মহিলা ৪৮.৪০%। মুসলমান ৮৮.২৭%, হিন্দু ৭.১৬%, খ্রিষ্টান ২.৩২% এবং অন্যান্য ২.২৫%।

 

১৯৭১ সালে কেটরা হাটে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের সম্মুখযুদ্ধে ৭ জন পাকসেনা ও ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা মারা যায়।

 

 নবাবগঞ্জঃ

নবাবগঞ্জ উপজেলার আয়তন ৩১৪.৬৮ বর্গ কিমি। উত্তরে ফুলবাড়ী উপজেলা, দক্ষিণে ঘোড়াঘাট এবং হাকিমপুর উপজেলা, পূর্বে পীরগঞ্জ(রংপুর), মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলা, পশ্চিমে বিরামপুর ও ফুলবাড়ী উপজেলা। করতোয়া, যমুনেশ্বরীও তুলসীগঙ্গা নদী এবং আওড়ার বিল উল্লেখযোগ্য। নবাবগঞ্জ থানা সৃষ্টি ১৮৯৯সালে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৩ সালে। ইউনিয়ন ৯, মৌজা ২১২, গ্রাম ২৭১।নবাবগঞ্জ উপজেলার মোট জনসংখ্যা ১৭০৩০১; পুরুষ ৫১.৭৭%, মহিলা ৪৮.২৩%। মুসলমান ৮৬.৪৮%, হিন্দু ৮.০৫%, খ্রিষ্টান ১.২২%, অন্যান্য ৪.২৫%।

 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী মতিহারা ও চড়া এলাকার প্রায় ৪০ জনস্থানীয় লোককে হত্যা করে।

 

হাকিমপুরঃ

হাকিমপুর উপজেলার মোট আয়তন ৯৯.৯২ বর্গ কিমি। উত্তরে নবাবগঞ্জ ও বিরামপুর উপজেলা, দক্ষিণে পাঁচবিবি উপজেলা, পূর্বে ঘোড়াঘাট উপজেলা, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও বিরামপুর উপজেলা। প্রধান নদী: ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গা। হাকিমপুর থানা সৃষ্টি ১৯৫০ সালে এবং থানাকে উপজেলায় রৃপান্তর করা হয় ১৯৮৪ সালে। পৌরসভা ১, ইউনিয়ন ৪, মৌজা ৬৯, গ্রাম ৯১।হাকিমপুর উপজেলার মোট জনসংখ্যা ৬৬৮৭৬; পুরুষ ৫১.৭৭%, মহিলা ৪৮.২৩%; মুসলমান ৯১.৫৬%, হিন্দু ৬.২৭%, খ্রিষ্টান ১.০৪%, অন্যান্য ১.১৩%।

 

 ১৯৭১সালে হিলি ছিল মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন। মুক্তিযোদ্ধারাভারতীয় সৈনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগের পথ হিসেবে একে ব্যবহার করে এবংপরবর্তীতে এইপথে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। হিলিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

 

 ঘোড়াঘাটঃ

ঘোড়াঘাট উপজেলার আয়তন ১৪৮.৬৭ বর্গ কিমি। উত্তরে নবাবগঞ্জ ও পীরগঞ্জ(রংপুর) উপজেলা, দক্ষিণে পাঁচবিবিও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে পলাশবাড়ী ও পীরগঞ্জ(রংপুর) উপজেলা, পশ্চিমে হাকিমপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলা। প্রধান নদী: করতোয়া। লালদহ বিল উল্লেখযোগ্য। ঘোড়াঘাট থানা সৃষ্টি ১৮৯৫ সালে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৪ সালে। ইউনিয়ন ৪, মৌজা ১১, গ্রাম ১১১। ঘোড়াঘাট উপজেলার মোট জনসংখ্যা ৮৪২৭৯; পুরুষ ৫১.৭৭%, মহিলা ৪৮.২৩%। মুসলমান ৮৬.৭৭%, হিন্দু ৭.২৭%, খ্রিষ্টান ১.৯৭% এবং অন্যান্য ৩.৯৯%।

 

 জেলার সীমান্ত তথ্যঃ

দিনাজপুরের পশ্চিমে ভারতের সীমান্ত রয়েছে। দিনাজপুর জেলার সাত(০৭) টি উপজেলার সাথে রয়েছে ভারতীয় সীমান্ত। ফুলবাড়ি ও হাকিমপুর উপজেলার পশ্চিমে; চিরিরবন্দর, বোচাগঞ্জ ও দিনাজপুর সদর উপজেলার দক্ষিণে; বিরামপুর এবং বিরল উপজেলার দক্ষিণে ও পশ্চিমে রয়েছে ভারতীয় সীমান্ত।

আরো পড়ুন – >>>

দিনাজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত