দিনাজপুর কালিয়া জীউ মন্দির

Nurun Nahar Saju 11/01/2024 No Comments

দিনাজপুর কালিয়া জীউ মন্দির

দিনাজপুর কালিয়া জীউ মন্দির

কালিয়া জীউ মন্দির কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত বাংলাদেশের দিনাজপুর শহরে অবস্থিত একটি মন্দির। দিনাজপুর রাজবাড়ির পশ্চিমে মন্দিরটির অবস্থান।

মন্দিরের ভোগ পরিবেশিত:

দিনাজপুর কালিয়া জীউ মন্দির

 

দিনাজপুর রাজবাড়িতে দুর্গা মন্দিরের উত্তর দিকে ঠাকুরবাড়ি মহলে কালিয়াজিউ মন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরটি ১৭০০ শতকে নির্মিত । জন্মাষ্টমীর দুদিন আগে ষষ্ঠীতে কান্তজিউ মন্দিরের রুক্মিণীকান্ত বিগ্রহকে এই মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। অতীতে ময়ূরপঙ্খী নৌকায় চড়ে ঢেপা নদী হয়ে সড়কপথে পদব্রজে চতুর্দোলায় জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রা করে বিগ্রহ আনা হত।

বর্তমানে এই প্রথা প্রচলিত থাকলেও সেই বিশেষ ময়ূরপঙ্খী নৌকার কোনও অস্তিত্ব নেই। দুর্গাপুজোর সময় ভক্তহৃদয় রাজবাড়িতেই কান্তজিউ বিগ্রহ দর্শন করতে পারে। প্রথানুযায়ী এই বিগ্রহকে তিনমাস রাজবাড়িতে রেখে রাসপূর্ণিমার দুইদিন পূর্বে ত্রয়োদশী তিথিতে পুনরায় পদব্রজে চতুর্দোলায় জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রা করে কান্তজিউ মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

দুর্গাপুজোর কয়েকদিন দেবী দুর্গার পাশাপাশি দেবী চামুণ্ডা, কালিয়াজিউ বিগ্রহ ও কান্তজিউ বিগ্রহকে দুপুরে বিভিন্ন প্রকারের ফল, লুচি-পুড়ি, ছানা-ক্ষীর, দধি-মাখন-সন্দেশ, মিষ্টি-মিষ্টান্ন এবং রাতে নানাপ্রকারের ব্যঞ্জনাদিসহ অন্ন ও ঘৃতান্ন ভোগ দেওয়া হত। অন্নভোগ তৈরি করা হতো সুগন্ধিকাটারিভোগ আতপ-চাল দিয়ে।

ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির বাংলাদেশেরএরপর এসব ভোগ পরিবেশিত হতো কাঁসার থালা-বাটিতে। সঙ্গে রূপা ও কাঁসার গ্লাসে পরিবেশন করা হত জল। প্রতিদিনের ভোগের প্রসাদ মহারাজা-মহারানি ও রাজকুমার-রাজকুমারীদের নিকটে পাঠানো হত। প্রতিমা-বিগ্রহাদির ভোগরাগের পর উপস্থিত সাধারণ ভক্ত-দর্শনার্থীরা ছাউনিযুক্ত সারি-সারি ঘরগুলোতে অবস্থান করে ভোগের প্রসাদ ও চরণামৃতের স্বাদ নিতে।

প্রতিষ্ঠার ইতিহাস:

কালিয়া জীউ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ইতিহাস নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে, তবে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, মন্দিরটি ১৭শ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়। এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্থানীয় জমিদার এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিরা, যারা কালী মাতার প্রতি তাঁদের গভীর ভক্তির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মন্দিরটি গড়ে তুলেছিলেন।

কালিয়া জীউ মন্দিরের প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু ধর্মের দেবী কালীর পূজা ও সেবা করা, যা আজও ধর্মপ্রাণ ভক্তদের কাছে একটি পবিত্র স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।দিনাজপুরের কালিয়া জীউ মন্দির বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় স্থান। এটি প্রায় ৫০০ বছর পুরোনো এবং দিনাজপুর জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত। মন্দিরটি মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় এবং কালী মাতার মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। স্থানীয় জনগণের কাছে এটি ‘কালিয়া জীউ’ বা ‘কালিয়াজীউ’ নামেই পরিচিত।

স্থাপত্যশৈলী:

কালিয়া জীউ মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী অসাধারণ এবং প্রাচীন বাংলার স্থাপত্যধারার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এটি লাল ইট এবং চুন-সুরকির তৈরি, এবং মন্দিরের চারপাশে খোদাই করা নানারকম কারুকাজ রয়েছে। মন্দিরটির প্রধান অংশটি ত্রিস্তর বিশিষ্ট, যা ধারাবাহিক তোরণ এবং কারুকার্যপূর্ণ স্তম্ভ দ্বারা অলংকৃত। মন্দিরের মূল ফটকে দুটি বড় পিলার রয়েছে যা শক্তিশালী নির্মাণশৈলীর নিদর্শন। মন্দিরের দেওয়ালে বিভিন্ন মূর্তি, ফুল ও দেব-দেবীর খোদাই করা চিত্র রয়েছে, যা তৎকালীন স্থাপত্যকলার উৎকর্ষতা প্রকাশ করে। মন্দিরের ছাদে রয়েছে গম্বুজ আকৃতির একটি মণ্ডপ যা প্রার্থনার সময় ব্যবহৃত হয়।

ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব:

কালিয়া জীউ মন্দির শুধু একটি পূজার স্থান নয়, এটি স্থানীয় সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিবছর মন্দিরে দুর্গাপূজা, কালীপূজা এবং দোলযাত্রার মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। এই অনুষ্ঠানগুলোতে শুধু দিনাজপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষই নয়, আশেপাশের এলাকা থেকেও প্রচুর ভক্ত জড়ো হন। পূজা উদযাপনের সময় মন্দির প্রাঙ্গণে মেলার আয়োজন করা হয়, যা স্থানীয় লোকজনের মধ্যে একটি মিলনমেলার আভাস দেয়। এছাড়াও, পূজার সময় অসংখ্য দোকান ও স্টল বসানো হয়, যেখানে মিষ্টান্ন, খেলনা, পিঠা-পুলির মতো স্থানীয় খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি করা হয়। 

ঐতিহাসিক ও পর্যটন গুরুত্ব:

কালিয়া জীউ মন্দির শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রও বটে। প্রতিদিনই অনেক পর্যটক এই মন্দির দেখতে আসেন। মন্দিরের স্থাপত্য এবং ঐতিহাসিক মূল্যবোধ পর্যটকদের মন কাড়ে। এটি বিশেষত ঐতিহাসিক স্থান ও সংস্কৃতি প্রেমীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য। পর্যটকরা এখানে এসে মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারেন এবং প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জন করতে পারেন।

সংরক্ষণ ও বর্তমান অবস্থা:

যদিও কালিয়া জীউ মন্দিরের অবকাঠামো দীর্ঘকাল ধরে টিকে আছে, বর্তমানে মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন। স্থানীয় প্রশাসন ও সরকার মন্দিরের সংস্কারে উদ্যোগ নিয়েছে। মন্দিরের কিছু অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গেছে, এবং সেই অংশগুলো পুনর্নির্মাণের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, পর্যটকদের সুবিধার্থে মন্দিরের প্রাঙ্গণে কিছু উন্নয়নমূলক কাজও করা হয়েছে।

উপসংহার:

কালিয়া জীউ মন্দির দিনাজপুরের একটি গৌরবময় ঐতিহ্যবাহী মন্দির। এটি কেবল হিন্দু ধর্মের উপাসনালয় নয়, বরং এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা যা স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে বহন করে। কালিয়া জীউ মন্দির প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের কাছে ভক্তি ও শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন->>>

দিনাজপুরের লোক সংস্কৃতি

দিনাজপুরের বিখ্যাত খাবার