সিংড়া ফরেস্ট দিনাজপুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যে

Sagar Kumar Kundu 10/23/2024 No Comments

সিংড়া ফরেস্ট দিনাজপুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যে

সিংড়া বন দিনাজপুর, বাংলাদেশের প্রকৃতি সৌন্দর্যের ভাণ্ডারে দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার সিংড় ফরেস্ট বা সিংড়া জাতীয় উদ্যান  এক অনন্য স্থান। সিংড়া ফরেস্টকে এক কথাই বলা যেতে পারে উত্তরবঙ্গের সুন্দরবন। এই বনভূমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অপরিহার্য উপাদান। সিংড়া ফরেস্ট তার সবুজ সমারোহ, অসংখ্য প্রাণী এবং দৃষ্টিনন্দন প্রকৃতি দিয়ে পর্যটক ও প্রকৃতিপ্রেমীদের মন জয় করে আসছে।

 সিংড়া-ফরেস্ট-দিনাজপুর

সিংড়া ফরেস্টের পরিচয়

সিংড়া ফরেস্ট মূলত দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার একটি বিখ্যাত বনভূমি। সিংড়া জাতীয় উদ্যানের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে নর্ত নদী। দিনাজপুর জেলা শহর থেকে সড়ক পথে ৪০ কি.মি. উত্তরে এবং বীরগঞ্জ উপজেলা থেকে ১৫ কি.মি. দূরে ভোগনগর ইউনিয়নে এর অবস্থান। এটি ৮৫৬ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত, যার প্রায় ৭৫৬ একর জায়গাকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয় ২০১০ সালে এবং প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। এরপর থেকে এটি পিকনিক স্পটে পরিণত হয়েছে। বনের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি খনন করে ২ ভাগে বিভক্ত হওয়া বনকে একসঙ্গে মেলাতে তৈরি করা হয়েছে সেতু। বনটির বেশিরভাগ অঞ্চলেই শাল গাছের আধিক্য দেখা যায়। তবে এর পাশাপাশি অন্যান্য উদ্ভিদ যেমন- আম, কাঠাল, মহুয়া এবং বিভিন্ন ধরনের গুল্ম-লতাও চোখে পড়ে। বনের ঘন গাছপালায় সৃষ্ট ছায়া এবং বাতাসের ঠাণ্ডা পরশ প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান তৈরি করে।

জীববৈচিত্র্যের এক অভয়ারণ্য

সিংড়া ফরেস্ট শুধুমাত্র গাছপালার জন্যই বিখ্যাত নয়, এটি বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও পাখির জন্যও একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বনের গভীর অঞ্চলে শেয়াল, বাঘরোল, বন্য শূকর এবং বিভিন্ন প্রজাতির হরিণের বসবাস রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ যেমন সাপ ও গিরগিটি এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি যেমন ময়না, শালিক, কাঠঠোকরা এখানে দেখা যায়। পাখিদের কিচিরমিচির ধ্বনি এই বনের প্রকৃতিকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।

উই-ঢিবি-সিংড়া-ফরেস্ট

আকর্ষণীয় গহীন অরণ্য দিনাজপুরের সিংড়া বন। বিশাল শালবনের গভীরে এখনও দেখা মেলে আগর, বাঁশ-বেত, গিলা লতা এবং দুর্লভ উই পকার ঢিবির। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও লতাগুল্ম রয়েছে, যা গুনে শেষ করা কঠিন। তবে ভূমিদস্যু ও কাঠচোরদের অত্যাচারের কারণে এই বন থেকে জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাওয়ার পথে। আগের মতো আর বন্যপ্রাণী চোখে পড়ে না।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

সিংড়া ফরেস্টের প্রকৃতি বছরের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। বর্ষাকালে বনের চারপাশে সবুজের সমারোহ দেখা যায়, যা পর্যটকদের মুগ্ধ করে। শীতকালে বনের গাছপালা এবং পাতাঝরার দৃশ্য এক আলাদা অনুভূতি সৃষ্টি করে। যেকোনো ঋতুতেই বনটি একটি সুন্দর ও প্রশান্ত পরিবেশ প্রদান করে, যা প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য আকর্ষণীয়।

সিংড়া ফরেস্টর গাছ

দিনের বিভিন্ন সময়ে বনের আলো-ছায়ার খেলা এবং পাখির শব্দে মিলে তৈরি হয় এক অপরূপ পরিবেশ, যা শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে দূরে সরে এসে কিছুক্ষণ প্রশান্তি খুঁজে পেতে সহায়ক।

স্থানীয় অর্থনীতি ও পর্যটন

সিংড়া ফরেস্টের প্রাকৃতিক সম্পদ শুধু পরিবেশের জন্য নয়, স্থানীয় অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এই বনাঞ্চলের আশেপাশে বসবাসরত মানুষেরা কাঠ, ফলমূল ও অন্যান্য বনজ পণ্যের উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও, পর্যটকদের আগমনে স্থানীয় ব্যবসা ও হোটেলের প্রসার ঘটেছে। সিংড়া ফরেস্টে ভ্রমণ করে প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে আসা মানুষদের জন্য এখানে স্থানীয় খাবার এবং হস্তশিল্প পাওয়া যায়, যা স্থানীয়দের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে।

সিংড়া ফরেস্টের পিকনিক

সিংড়া ফরেস্টের বিভিন্ন স্থানে পিকনিকের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে, যেখানে পর্যটকেরা নিজেদের খাবার রান্না করতে বা পরিবেশন করতে পারে। এছাড়াও, ছোট ছোট গাছের নিচে বসে খোলামেলা পরিবেশে খাবার খাওয়ার আলাদা মজা রয়েছে। পিকনিকের সময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে একে অপরের সাথে সময় কাটানো এখানে বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি করে।

পিকনিকের পাশাপাশি সিংড়া ফরেস্টের ভেতরে ছোটখাটো ট্রেকিংয়ের মজাও উপভোগ করতে পারেন। বনভূমির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন গাছপালা, প্রাণী এবং পাখিদের দেখতে পারবেন। বিশেষ করে, যাদের প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্য নিয়ে আগ্রহ রয়েছে, তারা এই বনভূমির অফুরন্ত রত্নের সন্ধান পাবেন। বনের পথে চলতে চলতে আপনি পাখির কিচিরমিচির, এবং বনের বিভিন্ন প্রাণীর উপস্থিতি টের পাবেন।

পিকনিক আয়োজনের পরামর্শ

১. সিংড়া বন দিনাজপুর, পরিকল্পনা: পিকনিক আয়োজনের আগে সিংড়া ফরেস্টের নির্দিষ্ট পিকনিক স্পটগুলো সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া উচিত। কয়েকটি জায়গায় অনুমতি নিয়ে পিকনিক করা হয়, তাই আগে থেকেই সঠিকভাবে পরিকল্পনা করে নেওয়া ভালো।

২. পরিবেশের যত্ন: সিংড়া ফরেস্টের মতো একটি সংরক্ষিত জায়গায় পিকনিক করতে গেলে অবশ্যই পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। প্লাস্টিক বা অন্যান্য বর্জ্য না ফেলে, নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

৩. সাথে নেওয়ার জিনিসপত্র: যেহেতু বনের মাঝে পিকনিক করতে আসবেন, তাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন- খাবার, পানি, রান্নার সামগ্রী, মাদুর বা চাদর নিয়ে আসতে হবে। বনভূমিতে বিশুদ্ধ পানির উৎস খুব কম থাকায় পর্যাপ্ত পানীয় জল সঙ্গে রাখা আবশ্যক।

সাওতাল পট্টি সিংড়া ফরেস্ট

সিংড়া বন দিনাজপুর, দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার সিংড়া ফরেস্টের আশেপাশে অবস্থিত একটি উল্লেখযোগ্য স্থান হলো “সাওতাল পট্টি”। এটি মূলত সাঁওতাল আদিবাসীদের বসতি হিসেবে পরিচিত, যারা বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ। সিংড়া ফরেস্টের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই সাঁওতাল পট্টি দিনাজপুরের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অন্যতম উদাহরণ। সিংড়া ফরেস্টের সাঁওতাল পট্টির বাসিন্দারা বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে এবং স্থানীয়ভাবে কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এদের জীবনযাত্রা বন ও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। আধুনিক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা তারা পর্যাপ্তভাবে পায় না। তবে, পর্যটন খাতের প্রসারের মাধ্যমে তাদের জীবনে কিছুটা উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। সিংড়া ফরেস্টে ভ্রমণে আসা পর্যটকরা সাঁওতাল পট্টি পরিদর্শন করে তাদের জীবনধারা সম্পর্কে জানতে পারে এবং এতে করে স্থানীয় অর্থনীতি কিছুটা উপকৃত হতে পারে।

ভ্রমণ নির্দেশিকা

সিংড়া ফরেস্ট ভ্রমণে যেতে হলে বীরগঞ্জ উপজেলা থেকে সহজেই যাতায়াত করা যায়। ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত ট্রেন বা বাসে যাওয়া যায় এবং সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে সিংড়া ফরেস্টে পৌঁছানো যায়। তাছাড়া দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলা থেকে গাড়ি ভাড়া করে সহজেই সিংড়া ফরেস্টে পৌঁছানো যাবে। দিনাজপুর থেকে বীরগঞ্জ যাওয়ার জন্য সবসময় ভ্রমণকারীরা দিনের বেলা বনের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে পারে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।

ফরেস্ট ভ্রমনে থাকার ব্যবস্থা

সিংড়া ফরেস্ট, দিনাজপুর ঘুরতে গেলে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি বিকল্প রয়েছে। ফরেস্টের আশেপাশে সরাসরি কোনো বড় হোটেল বা রিসোর্ট না থাকলেও বীরগঞ্জ ও দিনাজপুর শহরে বেশ কিছু হোটেল, গেস্টহাউস এবং রিসোর্ট আছে।

সিংড়া ফরেস্ট থেকে দিনাজপুর শহর বেশ কাছেই, তাই আপনি দিনাজপুর শহরের হোটেলগুলোতে থাকতে পারেন। এখানে বিভিন্ন মানের হোটেল পাবেন। কিছু জনপ্রিয় হোটেল হলো:

  • হোটেল গ্র্যান্ড নূর

সিংড়া বন দিনাজপুর, তাছাড়া দিনাজপুরে রয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের পর্যটন মটেল।সিংড়া ফরেস্টের সবচেয়ে কাছের শহর হলো বীরগঞ্জ। বীরগঞ্জেও কিছু সাশ্রয়ী হোটেল বা গেস্টহাউস রয়েছে যেখানে আপনি রাত যাপন করতে পারেন। তবে, দিনাজপুর শহরের তুলনায় এখানে থাকা খাওয়ার মান একটু সাধারণ হতে পারে।

শেষ কথা

সিংড়া ফরেস্ট প্রকৃতির সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য উদাহরণ। এটি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদের আধারই নয়, এটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের একটি মূল্যবান অংশ। পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সিংড়া ফরেস্টকে সঠিকভাবে রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটকদের দায়িত্ব হবে এই বনকে সুরক্ষা প্রদান করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এর সৌন্দর্য ধরে রাখা।

Faqs:

১. সিংড়া ফরেস্ট কোথায় অবস্থিত?

সিংড়া ফরেস্ট বাংলাদেশে দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। এটি ভোগনগর ইউনিয়নে, বীরগঞ্জ থেকে প্রায় ১৫ কি.মি. এবং দিনাজপুর শহর থেকে ৪০ কি.মি. দূরে অবস্থিত।

২. সিংড়া ফরেস্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ?

সিংড়া ফরেস্ট প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। এটি শালবনের আধিক্য, বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী, পাখি এবং উদ্ভিদ নিয়ে গঠিত। এটি স্থানীয় অর্থনীতি ও পর্যটন খাতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

৩. সিংড়া ফরেস্টের প্রধান আকর্ষণ কী কী?

প্রধান আকর্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে শালবন, নর্ত নদী, বনের জীববৈচিত্র্য (যেমন, শেয়াল,বনবিড়াল, পাখি), এবং পিকনিক ও ট্রেকিং করার সুযোগ।

৪. সিংড়া ফরেস্টে কিভাবে যাওয়া যায়?

দিনাজপুর থেকে বীরগঞ্জ উপজেলায় গাড়ি নিয়ে সিংড়া ফরেস্টে পৌঁছানো যায়। ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে বাস বা ট্রেনে দিনাজপুর পৌঁছে সেখান থেকে গাড়ি বা বাসে বীরগঞ্জ হয়ে সিংড়া ফরেস্টে যাওয়া সম্ভব। বাসে আসলে প্রথমে বীরগঞ্জ নামে  অটোতে আসতে হবে।

দিনাজপুর সম্পর্কে আরও জানুন- >>>

স্বপ্নপুরী পিকনিক স্পট দিনাজপুর

দিনাজপুর রামসাগর

দীপশিখা মেটি স্কুল, দিনাজপুর

দিনাজপুর পার্বতীপুর জংশন রেলওয়ে স্টেশন