কান্তজীউ মন্দির দিনাজপুর ঐতিহ্যের এক অপূর্ব স্থাপত্য নিদর্শন

Sagar Kumar Kundu 10/23/2024 No Comments

কান্তজীউ মন্দির দিনাজপুর ঐতিহ্যের এক অপূর্ব স্থাপত্য নিদর্শন

কান্তজীউ মন্দির দিনাজপুর, কান্তজিউ মন্দির বা কান্তজীর মন্দির হচ্ছে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার অবস্থিত একটি মধ্যযুগের হিন্দু মন্দির। মহারাজা প্রাণনাথ রায় মন্দিরটি শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর স্ত্রী রুক্মিণীকে উৎসর্গ করে নির্মিত করেছিলেন। এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র রাজা রামনাথ রায়ের রাজত্বকালে শেষ হয়।  ১৮৯৭ সালে সংঘটিত একটি ভূমিকম্পে মন্দিরটির নবরত্ন বা ‘নয় শিখর’ ধ্বংস হয়ে যায় । এ মন্দিরে বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শন রয়েছে যা  একটি দেখার মত নিদশন। পৌরাণিক কাহিনীসমূহ পোড়ামাটির অলঙ্করণে দেয়ালের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

এই মন্দিরের নির্মাণ এবং সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য সুদূর পারস্য থেকে নির্মান শিল্পীদের আনা হয়েছিল । মন্দিরের দক্ষিণ দিকে নয়াবাদ নামক গ্রামে রাজা প্রাণনাথ নির্মাণ শিল্পী এবং শ্রমিকদের বসবাসের জন্য জমি দান করেন। এই শ্রমিকদের অধিকাংশই ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তাই ধর্মীয় প্রার্থনা পালনের জন্য তারা নয়াবাদ মসজিদ নির্মাণ করেন যা একই এলাকার আরেকটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।

বহু বছর ধরে প্রতি বছর শীতের শুরুতে মন্দির প্রাঙ্গণে এক মাস ব্যাপী রাস মেলা অনুষ্ঠিত হয়। জানা যায় মহারাজা রামনাথ রায়ের সময়কাল থেকেই এই রাস মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলা চলাকালীন সময়ে অনেক তীর্থ যাত্রী ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মন্দিরে তীর্থ যাত্রা করতে আসেন।

অবস্থান

কান্তজিউ মন্দির দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং কাহারোল উপজেলা সদর থেকে  মাত্র ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরপুর ইউনিয়নে, দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেঁপা নদীর তীরবর্তী গ্রাম কান্তনগরে অবস্থিত। কান্তজীর মন্দির দিনাজপুর

ইতিহাস

কান্তজিউ মন্দিরের উত্তর দিকের ভিত্তিবেদীর শিলালিপি থেকে জানা যায়, তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তার শেষ বয়সে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পরে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মহারাজা রামনাথ রায় (মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায়ের পোষ্যপুত্র) ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। শুরুতে মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিলো প্রায় ৭০ ফুট। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটি ভূমিকম্পের কবলে পড়লে এর চূড়াগুলো ভেঙে যায়। বিশ শতকের শুরুর দিকে মহারাজা গিরিজানাথ মন্দিরের ব্যাপক সংস্কার করার পরেও মন্দিরের চূড়াগুলো আর সংস্কার করা হয়নি।

যাতায়েত বেবস্থা

দিনাজপুর থেকে কান্তজীর মন্দিরে যাওয়ার জন্য আপনি কয়েকটি উপায়ে ভ্রমণ করতে পারেন:

বাসে

দিনাজপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে কান্তজীর মন্দির পর্যন্ত সরাসরি বাস পাওয়া যায় না। তবে আপনি দিনাজপুর থেকে কাহারোল উপজেলায় বাসে যেতে পারেন। এরপর কাহারোল থেকে অটোরিকশা বা টেম্পোতে কান্তজীর মন্দিরে পৌঁছাতে পারবেন। কাহারোল উপজেলা থেকে মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার।

ট্রেনে

দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে কাহারোল রেলস্টেশনে পৌঁছানোর জন্য ট্রেনে যেতে পারেন। এরপর কাহারোল থেকে রিকশা বা ভ্যান নিয়ে কান্তজীর মন্দিরে যেতে পারবেন, তবে বাসের চেয়ে তুলনামুলক সময় বেশি লাগবে

ব্যক্তিগত যানবাহনে

যদি আপনার ব্যক্তিগত গাড়ি থাকে, তবে দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কাহারোল উপজেলায় অবস্থিত কান্তজীর মন্দিরে সরাসরি পৌঁছাতে পারেন। গুগল ম্যাপ ব্যবহার করলে সঠিক পথ নির্দেশনাও পাবেন।

স্থাপত্

মন্দিরের বাইরের দেয়ালে পোড়ামাটির ফলকে রামায়ণ, মহাভারত এবং অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনীর চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পুরো মন্দিরজুড়ে প্রায় ১৫,০০০ টেরাকোটা টালি রয়েছে। মন্দিরটি তিনটি স্তরে উপরে উঠেছে, এবং চারদিকের প্রতিটি খিলান দিয়ে ভেতরের দেবমূর্তিকে দেখা যায়। আয়তাকার প্রাঙ্গণের মন্দিরটি ৫০ ফুট উচ্চতায় পাথরের ভিত্তির উপর নির্মিত বর্গাকার আকৃতির। নিচতলার প্রতিটি প্রবেশপথে বহু খাঁজযুক্ত খিলান রয়েছে, যা ইটের দুটি স্তম্ভ দ্বারা বিভক্ত, এবং এগুলো অত্যন্ত সুন্দর অলংকরণে সমৃদ্ধ। মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি উপরের দিকে উঠেছে। নিচতলায় ২১টি, দ্বিতীয় তলায় ২৭টি এবং তৃতীয় তলায় ৩টি করে দরজা-খিলান রয়েছে।

কান্তজীর মন্দির গুরুত্ব

কান্তজীর মন্দির বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক এবং স্থাপত্যশৈলীর দৃষ্টিনন্দন নিদর্শন। এই মন্দিরের গুরুত্ব বিভিন্ন দিক থেকে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:

কান্তজির মন্দির টেরাকোটা

১. স্থাপত্যশৈলী

কান্তজীর মন্দির বাংলার টেরাকোটা স্থাপত্যের এক অনন্য উদাহরণ। এর বাইরের দেওয়ালজুড়ে পোড়ামাটির ফলকে রামায়ণ, মহাভারত এবং পৌরাণিক কাহিনীর দৃশ্যাবলী খোদাই করা হয়েছে, যা এক অভূতপূর্ব শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত। প্রায় ১৫,০০০ টেরাকোটা টাইলসের ব্যবহারে মন্দিরটি অলঙ্কৃত করা হয়েছে, যা মধ্যযুগীয় বাংলার শিল্প ও স্থাপত্যের উৎকর্ষ প্রকাশ করে।

২. ধর্মীয় গুরুত্ব

কান্তজীর মন্দির হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান। এটি রাধাকৃষ্ণের মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এখনো ধর্মীয় উৎসব ও পূজা উপলক্ষে ভক্তদের সমাগম ঘটে। প্রতিবছর মন্দির প্রাঙ্গণে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, যা সারা দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একত্রিত করে।

৩. রাশ মেলা

রাশ মেলা  কান্তাজীর মন্দিরকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর কার্তিক মাসে (অক্টোবর-নভেম্বর) পালিত হয়। এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব, যা শ্রীকৃষ্ণের জীবন এবং লীলার উপর ভিত্তি করে উদযাপিত হয়। রাশ পূর্ণিমার দিন থেকে শুরু হয় এবং সাধারণত এক মাস ধরে অনুষ্ঠিত হয় যেখানে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মেলায় আসে নানা ধরনের পণ্যসামগ্রী ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড। এই মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ অংশগ্রহণ করেন।

কান্তাজীর মন্দিরের রাশ মেলা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও, যা স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা তৈরি করে।

৩. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

কান্তজীর মন্দির ১৭৫২ সালে মহারাজা প্রাণনাথ কর্তৃক নির্মিত হয় এবং পরবর্তীতে মহারাজা রামনাথ এর কাজ শেষ করেন। এটি মুঘল আমলের শেষদিকে নির্মিত এবং মুঘল ও হিন্দু স্থাপত্যের মিশ্রণ এই মন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মন্দিরটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ধারক হিসেবে বিবেচিত হয়।

৪. পর্যটনকেন্দ্র

এটি দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। কান্তজীর মন্দিরে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা থাকে, যারা এই স্থাপত্যের সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপভোগ করতে আসেন। এটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করে।

৫. সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

এই মন্দির বাংলার মধ্যযুগীয় সংস্কৃতি, ধর্ম, ও শিল্পের সমৃদ্ধির প্রতীক। এর টেরাকোটার কাজগুলো কেবল ধর্মীয় কাহিনীগুলোর চিত্রায়ণ নয়, বরং সে সময়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেরও প্রতিফলন।

এইসব কারণে কান্তজীর মন্দির বাংলার স্থাপত্য, ধর্ম এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।

FAQs:

১. কান্তজির মন্দির কত সালে নির্মাণ করা হয়?

কান্তজীউ মন্দির দিনাজপুর, এটির নির্মাণ ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় এবং ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামনাথ রায়ের রাজত্বকালে শেষ হয়।

২. কান্তজির মন্দির কোন জেলায় অবস্থিত?

কান্তজীর মন্দির বা কান্তজীউ মন্দির বা নবরত্ন মন্দিরটি ১৮ শতকে  নির্মিত বাংলাদেশের দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ঢেঁপা নদীর তীরে অবস্থিত।

৩. কান্তজির মন্দির কেন বিখ্যাত?

এ মন্দিরে বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শন রয়েছে । পৌরাণিক কাহিনীসমূহ পোড়ামাটির অলঙ্করণে দেয়ালের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

আরো জানতে – >>>

দিনাজপুর রামসাগর

দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ বড় ময়দান: ঐতিহ্য ও স্মৃতির বাতিঘর